সোনামুখ স্বপ্নচারা ফাউন্ডেশন। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আন্দুলিয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান। ২০২০ সালের ২৫ মে যাত্রা শুরু ফাউন্ডেশনটির। গরীব, অসহায় নারী-পুরুষদেরকে কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে স্বাবলম্বী করা এবং কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মেধা ও মনন বিকাশে ভূমিকা রাখাই প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য।
একজন স্বপ্নবাজ মানুষ, সোনামুখের প্রতিষ্ঠাতা এএম কামরুল ইসলাম। তিনি একক কোনো সত্তা নন। কেননা তার বুনে দেওয়া স্বপ্নগুলো হাজারও সোনামুখের মনে বিচরণ করে। বীজ থেকে অঙ্কুর, তা থেকে চারা অতঃপর গাছ এবং তা থেকে আবারও বীজ আর এভাবেই অন্তহীন পথে ছুটে চলা। আমরা চেয়েছি সোনামুখ সংগঠনের চলমান নানারকম সাহায্য সহযোগিতার কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি নতুনভাবে কিছু করা, যেখানে অসহায় মানুষেরা একইভাবে নিজে উপকৃত হবে এবং অন্যদেরও একইভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করবে।
অর্থাৎ, মানুষ (নারী ও পুরুষ উভয়ই) সরাসরি জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ (নগদ টকা/মালামাল /যার যেটাতে উপার্জন হয়) পেয়ে নিজের জন্য আয়ের উৎস সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করবে। অতঃপর তার সুবিধাজনক সময়ে, সুবিধাজনক পরিমাণে কেবলমাত্র আসল টাকাটা তারই মতো অসহায় অন্য কাউকে সে একই শর্তে দিয়ে দিবে (নিয়মিত তদারকি আবশ্যক)। এভাবেই চলতে থাকবে ছোঁয়াচে এই কাজগুলো। যাতে করে একই টাকাই উপকার ভোগীর সংখ্যাটা সর্বোচ্চ হয়। তাইতো এই “সোনামুখ স্বপ্নচারা”।
এটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আমার অনুভূতি
এ এম কামরুল ইসলাম (প্রিয় নানুভাই) এর স্নেহ ভালোবাসায় সিক্ত আমি নিতান্তই গরীবের ছেলে “মুজাহিদ”। ছোটবেলা থেকে তাকে দেখে দেখে শুনে শুনে বড় হয়েছি। তিনি আমাকে তখনও চেনেন না যতক্ষণে আমি বয়সে অনেক বড়।
তার কাছে ছুটে গিয়েছি অজানা এক স্রোতের টানে ও তার মহানুভবতার সুবাদে কেননা তার মত বড় মনের ও মাপের একজন মানুষের কাছে পৌঁছানো কঠিন ছিলো সমাজের সিস্টেমে। তবে যখনই একটু সাহস সঞ্চয় করে আমি তাকে নিজের ভাবনাতে এঁকেছি তখনই নিজ গুণে আমাকে এক ঝটকায় শতভাগ আপন করে নিয়ে আমার আকাশকুসুম চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিলেন তিনি।
একদিন বলে ফেললাম মানুষের জন্য কার্যকরী কিছু করতে আমিও শরিক হতে চাই। যেখানে স্বচ্ছতা থাকবে এবং অল্প টাকায় উপকারভোগী হবেন অনেক বেশি। সাথে সাথে তিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করলেন এবং ফান্ডিংসহ সব ব্যবস্থা অতিদ্রুত করে দিলেন। সে অনুভূতি ভাষায় লেখা সম্ভব নয়। চেষ্টা করেছি কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে। হয়তো কিছু পেরেছি, হয়তোবা সবটাই বাকি।
দায়িত্বরত অবস্থায় আমার অভিজ্ঞতা –
কিছু মহান উদ্দেশ্য নিয়ে বিগত ৩০-০৮-২০১৮ থেকে ১৭-১০-২০১৮ তারিখ গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পায়ে হেঁটে গিয়ে লিখিত ফর্ম পূরণ করে সকল পরিবারের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করি। পরবর্তীতে সেগুলো ল্যাপটপে ডাটাবেইজে ইনপুট দিয়ে তৈরি করি বিশাল এক তথ্য ভান্ডার। যেখানে ছিলো ৫৬৮ টা পরিবারের বিশদ তথ্য, যেমন- পরিবার প্রধানের ছবি, মোবাইল নং,পেশা,আর্থিক অবস্থা,উপার্জনক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা, গৃহপালিত পশুপাখির তথ্য,মৎস্য ঘেরের সংখ্যা, জমির পরিমাণ, বাড়িঘরের অবস্থা, সন্তানদের সমূদয় তথ্য- সন্তানদের বয়স,শিক্ষাগত যোগ্যতা,ভবিষ্যত পরিকল্পনা, পরিবারের সবার রক্তের গ্রুপ ইত্যাদি। এছাড়াও উন্মুক্ত ছিলো সোনামুখ পরিবারের জন্য তাদের মতামত, অভিজ্ঞতা, পরামর্শ, সমালোচনা ইত্যাদি। প্রাপ্ত বিচিত্র এই তথ্যভান্ডার আমাকে অভিভূত করে, পুরো চিত্র বিশদভাবে তুলে ধরি সোনামুখের প্রতিষ্ঠাতা সহোদর, এ এম কামরুল ইসলাম ও এ এম হারুনর রশীদ, দুই মহৎ ব্যক্তিত্বের সামনে। এবং পরিকল্পনা চলতে থাকে কিভাবে আলাদা আলাদা করে মানুষের স্ব স্ব প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়ানো যায়। সেখান থেকেই একদিন যাত্রা শুরু সোনামুখ স্বপ্ন চারার যেটি সোনামুখ পরিবারের বৃহৎ কর্মযজ্ঞের একটিমাত্র ক্ষুদ্র শাখা।
যদি বলি কিছু ভালো লাগা বাঁধ ভেঙেছে তবে বলবো-
১. প্রথমেই করেছিলাম অসহায় অসুস্থ নিজ বড় মামার জন্য (যে নাই আজ দুনিয়াতে)। ছাগলের ছোটখাটো একটা ফার্ম করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেছিলাম। চলছিলো। শেষমেশ ফার্ম হয়নি। তবে প্রাপ্তি বলবো শতভাগ।
২. এলাকার দু’জন ছেলে যারা দায়দেনার জন্য পালিয়ে বেড়ায়, জীবিকার উৎসও নাই এবং একজন সারাজীবন বসে খাওয়া কাজ না করে চলা লোক। তাদেরকে পেরেছি আয় রোজগারের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে। আর পালিয়ে না বেড়িয়ে দেনা পরিশোধে সক্ষম করে তুলতে।
৩. পেরেছি বেশ ক’জন মেয়ে ও মহিলাকে তাদের স্বপ্নের সেলাইমেশিনের মালিক করতে।
৪. পুত্র শোকে কাতর, পরগৃহে কাজ করে খাওয়া এক মহিলাকে পেরেছি ছাগলের মালিক বানিয়ে অতঃপর গরুর মালিক করতে। এইরকম গরুর মালিক আরও আছে ও হবে।
৫. অনেকগুলো কর্মঠ মানুষ আজ তাদেরই চোখের সামনে তৈরিকৃত নিজ পছন্দসই ভ্যানগাড়ীটির একক মালিক। তারা সেগুলো থেকে আজও আয় করে চলেছে।
৬. কিছু ব্যবসায়ীর দোকানের ফ্লোর এখন পাকা, আয় রোজগারও চলছে দোকানভর্তি মালামাল থেকে।
৭. ইজিবাইক কেনাটা যখন কেবলই আয়োজন। তখন আমরা তাকে করেছি ইজিবাইকের মালিক রাতারাতি। কেননা সে নিজেকে নিজে সাহায্য করেছে। আজও চোখের সামনে চলে সে বাহন।
৮. মহিলা যারা উপকারভোগী তারা একজনও তাদের কথার বরখেলাপ করেনি। এটাতে সফলতার হার শতভাগ। নিজের উন্নয়ন করে তারা অপরকেও স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছে।
৯. কিছু জামিনদার ও কিছু গ্রাহকের স্ত্রীদের অবদান ছিলো।
১০. কেউ তাদের কথা রেখে চলেছে, নিজ ভাগ্য উন্নয়ন নিজেই করছে দেখতে ভালো লাগে। তারাই আইডল।
১১. দশ লাখ টাকা দশ কোটি টাকা হয়ে সবার উপকারে ছড়িয়ে যেতে সময় লাগে না এতে।
আর যদি বলি কিছু খারাপও লেগেছে, বলবো-
১. মানুষ সুযোগ নিতে চায়, এ সমাজে না বলতে শিখতে হয়। সবাই খুশি হয় না।
২. মানুষ সুযোগ নিয়েই ফেলে, কেউ কেউ প্রতিশ্রুতি রাখেনি, পালিয়েছে।
৩. কষ্ট করে ভ্যানগাড়ীটির মালিক হয়েও কেউ কেউ আজও তার পূর্বের অবস্থানে।
৪. কেউতো আবার ধনবান কড়া জামিনদার সেজে ভদ্রলোকের লেবাসে অসহায় লোকের থেকে সুবিধা আদায় করেছে।
৫. টাকা হজম করে ফেলতে চায়, প্রার্থী যাচাই সঠিক প্রক্রিয়ায় হলেও।
৬. জামিনদারের ভূমিকা হতাশাজনক।
৭. কাছের মানুষ দূর হতে থাকে তবে ব্যাপার নাহ।
৮. কথা রাখাটাও সবার পক্ষে খুব চ্যালেঞ্জিং। খুব করে মাথায় হাত বোলাতে হয় নিয়মিত।
৯. গ্রাহকদের সবার উন্নয়নে সমিতি চালু করে দিলেও তাতে ফল মেলেনি।
সারাংশ
সোনামুখ স্বপ্নচারা থেকে আজ অবধি নানাভাবে মানুষকে সাহায্য করা হয়েছে। যেমন-
* ২১ জনকে মোট মিলিয়ে ৬,৮৮০০০/- টাকা সহায়তা দেওয়া।
* ১৩ জনকে তাদের জীবিকার জন্য ভ্যান গাড়ীর ব্যবস্থা করা।
* একজনকে ইজিবাইক কিনতে সাহায্য করা ও অন্য একজনকে ইজিবাইকের ব্যাটারি কিনতে সাহায্য করা।
* ৫ জনকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণে সাহায্য করা।
* অনেকগুলো সেলাই মেশিন দেওয়া।
* অনেকগুলো ছাগল দেওয়া।
* কাউকে কাউকে মেডিকেল ও জরুরি সেবা প্রদান ইত্যাদি।
* চলমান আছে আরও নানারকম চিন্তাভাবনা।
সবশেষে বলবো, প্রত্যাশা কম রেখেই কেবল করণীয়গুলো করে যেতে হবে। নিজেকে যারা হেল্প করে থাকে আমরা কেবল সেসব অসহায় নিষ্ঠাবান মানুষদেরই উপকার করতে পারবো। দিনশেষে সবাই একসাথে হাসবো।
আর বলবো, “আমরা সবাই সোনামুখ ভালো কাজে মোদের সুখ।”
সোনামুখ ছাদ স্কুল:
করোনার লকডাউনে কামরুল ইসলামের গ্রামের বাড়িতে ছাদের উপরে এই কার্যক্রম শুরু করা হয়। তাই এমনি এমনই নাম হয়ে যায়- সোনামুখ ছাদ স্কুল।
২০২০ সালের শুরুতে করোনাকালীন স্কুল বন্ধের সময় এর যাত্রা শুরু হয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সহায়তা করা। নেশা, মাদক, জুয়া, মোবাইল আসক্তি, করোনার ভয় সবকিছু থেকে দূরে রেখে তাদের নার্সিং করাই যার মূল উদ্দেশ্য।
প্রাণকেন্দ্রে যারা ছিলেন- সাবিত, মারিয়া, জিম, পিংকি, মাফি, রুবাইয়া, পিকুল, মেহেদী, জাকিয়া, জাকারিয়া, মৌমি, দীপ্তি, লামিয়া, বর্ষণ, সামিয়া, মাশরাফি, বৈশাখী, দিমা, অমি, মাহিম, নাইম, ছাইল, তিথি, তুয়া, পিয়াসহ আরও অনেকে।
যাদের ছোঁয়া ও অবদানে ছাদ স্কুল বিকশিত- এবিডি নোমান ভাই, গাজী মেজবাহ ভাই, ফয়সাল বিশ্বাস, চৈতী আপু, অধ্যাপক ড. আনোয়ার এইচ জোয়ারদার স্যারসহ আরও অনেক ডক্টরেট ডিগ্রীধারী গুণী স্যারসহ অনেক সুধীজন।
**সোনামুখ ছাদ স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিদিন নিয়মিত পাঠদান, কুইজ প্রতিযোগিতা, বিতর্ক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক চর্চা, অভিনয়, বক্তব্য, হাতের লেখা চর্চা, সাধারণ জ্ঞান, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, উপস্থিত বক্তৃতার আয়োজন করা হত।
**পথ কুকুরের হোটেল উদ্বোধন ও নিয়মিত পরিচালনা- সেপ্টেম্বর ২৯. ২০২০, লাইব্রেরি পরিদর্শন, উদ্ভাবনী জিনিসপত্র/যন্ত্রপাতি প্রদর্শনী- সেপ্টেম্বর ৪,২০২০, মায়ের খুশি অনুষ্ঠান-মে ২৯.২০২০, মায়েদের সম্মেলন, বিভিন্ন পরীক্ষা ও পুরস্কার বিতরণ, বনভোজন, ইফতার সামগ্রী বিতরণ এপ্রিল ২৫.২০২১, কোরবানির মাংস বিতরণের সবার স্বাবলম্বিতা, গাছ লাগানো ও পরিচর্যা প্রতিযোগিতা, পাখিদের সুরক্ষার জন্য কাজ করা, গ্রামের মুরব্বিদের প্রত্যেকের নিজস্ব পছন্দমতো খাবার ও উপহার প্রদান, মসজিদে শিশুকিশোর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজিদের পুরস্কার বিতরণ মে ২৮. ২০২১, গ্রামের কিশোরীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম জুলাই ১৬. ২০২১, গ্রামের রাস্তা সংস্কার সহ আরও অনেক কিছু।
* ছাদ স্কুলের ছেলেমেয়েরা এখনও তাদের ধারা ধরে রেখেছে, শিখে চলেছে নানান অভিজ্ঞতা, তারা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, সচেতন ও নিবেদিত প্রাণ। তাদের সবার জন্য মন থেকে দুআ চাই।
সোনামুখ ছাদ স্কুল পরিদর্শনে আসেন যারা- অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল হক জোয়ারদার, অধ্যাপক মাজহারুল হান্নান, অধ্যাপক ড. সন্দীপক মল্লিক, অধ্যাপক ড. ইঞ্জিনিয়ার বিভূতি রায়, অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক বদিউজ্জামান, অধ্যাপক ড. ইয়াহ্ইয়া আখতার, অধ্যাপক হাফিজুর রহমান, অধ্যাপক জগলুল কাদের, জার্মান প্রবাসী আনজাম মালিক, অধ্যাপক ড. বিশ্বাস শাহীন আহম্মেদ, অধ্যাপক আব্দুল করিম, অধ্যাপক ড. খ ম রেজাউল করিম, অধ্যাপক ড. শাহ আলম ও মিসেস শাহ আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী প্রিয়ন্তী মন্ডল, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ, মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক রুমানা আহমেদ, কিংবদন্তি ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলাম, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষক মোনা মারজান।
লেখক : সহকারী অফিসার, আইএফআইসি ব্যাংক, খুলনা।
খুলনা গেজেট/এনএম